কবির জন্মদিন ও ফাঁকির বৃন্দাবন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : মঙ্গলবার, ২৬ মে, ২০২০

এনকে বার্তা ডেস্ক::

প্রায় শতবছর আগে বিশ্ব মনবতার মুক্তি ও উপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ ছিন্ন করার প্রবল প্রত্যয় নিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে বাণীর উদ্বোধন করেছিলেন তা আজও অনির্বাণ।এই শতবছরে উপনিবেশিক বাংলা নয়া-উপনিবেশিক হয়েছে কিন্তু নজরুলের সৃষ্টি রয়ে গেছে সমান প্রাসঙ্গিক।

দ্রোহ আর প্রেমের অপূর্ব যুগলবন্দীর স্রষ্টা এই কবি বলেছিলেন, ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেবনা ভুলিতে..’। সত্যিই তাই, সব সংকটেই বারবার ফিরে যেতে হয় তাঁর কাছে। চাইলেই ভুলে থাকা যায় না। আজ কবির ১২১ তম জন্মদিন, হাজার বছর পরও তিনি থাকবেন সমসাময়িক।

উৎসবে আনন্দে, প্রেম-প্রকৃতিতে এবং মারি ও মড়কে এই উপমহাদেশের মানুষকে নজরুলের মতো আর কোন কবি বোধ করি এতবেশি দোলায়িত করেননি। তাইতো করোনার এই মহামারি লগ্ন, মানব সভ্যতার নিদারুণ অসহায়ত্ব, বেশুমার নির্ণয়হীন অসুখ আর অচিকিৎসিত মৃত্যু ও রাজ-উমেদারদের অসহনীয় আস্ফলনের মাঝে আকাশে ওঠা শাওয়লের চাঁদের যথার্থ উপমা নজরুলেই খুজে ফিরতে হয়। ‘আসমান-জোড়া কাল কাফনের আবরণ যেন টুটে/এক ফালি চাঁদ ফুটে আছে, মৃত শিশুর অধর-পুটে ..’এর চেয়ে ভাল উপমা আর কি হতে পারে!

এই করোনাকালে নজরুল প্রাসঙ্গিক হয়ে সামনে আসেন তখনি, যখন নিরন্ন, নিরাশ্রয় মানুষের রক্ত-ঘামে পুষ্ট রাজ-কর্মচারীরা মহামারীর প্রথমসারীর যোদ্ধা খেতাব নিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িতে হুইসেল বাজিয়ে ঈদ উদযাপনে ছোটে আর অন্নের জোগাড়ে নাঙ্গা পায়ে রাস্তায় নেমে আসা অর্থহীন-কর্মহীন মানুষের ঘাড়ে মহামারী ছড়ানোর দায় চাপে।

কবি শতবছর আগে ‘দেশের সমস্ত কল-কারখানায়, আড়তে, গুদামে ‘ভাবিয়া চিন্তিয়া মানুষ হত্যার’ এই বিভৎস নগ্নতা দেখিতে পাইবেন’ লিখেছিলেন যেন আজকের মহামারীকেই উদ্দেশ্য করে। নয়তো কি আর রাজপদোপজীবীরা ঘরে লুকিয়ে থেকে ‘ম্লেচ্ছ’ শ্রমিক-কৃষককে কারখানায়-কর্মক্ষেত্রে যেতে বাধ্য করে?

বাঙ্গালির ব্যবসাদারির পূঙ্খানুপুঙ্খ উপলব্ধি কবির ছিলো বলেই নিঃসংকোচে বলতে পেরেছেন ‘ভণ্ড লক্ষপতি অপেক্ষা দরিদ্র তপস্বী ঢের ভাল’।

প্রাইভেট গাড়ি থাকলেই কেবল ঈদের যাত্রায় শরীক হওয়া জায়েজ হবে ফকির-ফাকরাদের জন্য না-জায়েজ এই হুকুম প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে যারা জারি করলেন তারা বাংলাদেশকে নিজেদের মালিকানাধীন প্রাইভেট কোম্পানি আর জনগণকে সেই কোম্পানির চাকর-বাকর বৈ অন্য কিছু ভাবেন না। উচ্চ আয়ের পথে উত্তীর্ণের মায়াময় গল্পের ফাঁদে পড়া এই দেশের নিরন্ন-নিপীড়িত মানুষ এই মহামারীতে কাদের হৃদয়হীনতার প্রয়াশ্চিত্ব করছে জানি না! তবে কবির জন্মদিনে আজ তারই মতো করে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় ’এ কি শাসকের উৎপীড়ন নয়?’

প্রায় শতবছর আগে কবি তাঁর যুগবাণীতে বলেছিলেন’ভাঙো দাসত্বের নিগড়… খোদার উপর খোদাকারী শক্তিকে দলিত করো … এই স্বার্থের শাসনকে শাসন করো’।

কবির অনিবার বাণীতেই স্মরি কবিকে এই করোণাকালে, নিজের কথা প্রকাশের শক্তির অভাবে। সে শক্তি যতটা না সংকুচিত হয় ভাবের অভাবে তার থেকে শতগুন ক্ষীণ হয় রাজরোষের ভয়ে। কবি অবশ্য বলেছেন, ‘ যার মনের জোর নাই, সত্যের জোর নাই, সেই এমন করিয়া গায়ের জোরে দুর্বলকে থামাইতে চেষ্টা পায়’।

নির্ণয়হীনব্যাধী, বেশুমার অচিকিৎসিত মৃত্যু, বঙ্গদেশ প্রইভেট লিমিটেড কোম্পানীর মালিকদের বিশেষ শশ্রুষাব্যবস্থা, রাজকোষের যথেচ্ছ ব্যবহার, অনাহার, উৎপীড়ন, সর্বজনের সম্পদ লুন্ঠণ-চুরি ইত্যকার বিষয়ে আলোচনা বন্ধে আইনের সিল মোহরের ব্যবহার ব্যাপকতা লাভ করেছে। আর তাই প্রাসঙ্গিক কারণেই কবি নজরুল থেকে ঋণ করা, ‘দেশের লোক এখন তাহাদের ঘরের অবস্থা সাদা চোখে স্পষ্ট করিয়া দেখিতে পাইয়াছে। ঘরে যে সিঁদেল-চোর ঢুকিয়াছে, এতদিনে তাহারা তাহা টের পাইয়া চোরের টুঁটি টিপিয়া ধরিয়াছে। … চোরে-গৃহস্থে দস্তুরমতো এখন এই ধস্তাধস্তি চলিতেছে। তবে চোরের সুবিধাটা এই যে, সে বেশি জোরালো, তার হাতে হাতিয়ারও আছে, আর গৃহস্থ বেচারা একেবারে নিরস্ত্র’।

মানুষকে ফাঁকিতে ফেলে বাহবা অর্জনে উমেদার আবশ্যক। যদিও উমেদার নিজের স্বার্থ সিদ্ধির উপায় হিসেবে শাসকের মিথ্যা প্রশংসার তুবড়ি ছুটায় কিন্তু শেষ বিচারে তার আত্মপ্রবঞ্চণা তাকেই পীড়িত করে।

‘আমাদের সকলের মধ্যে নিরন্তর এই ফাঁকির লীলা চলেছে। আর বাংলা হয়ে পড়েছে ফাঁকির বৃন্দাবন’ এই মহামারীর দিনে এর থেকে ধারালো উপলব্ধি আর কি হতে পারে? এই ’ফাঁকির বৃন্দাবন’ থেকে শুভ জন্মদিন কবি।


এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১