করোনা মহামারিতেই আসছে স্বস্তির বাজেট

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : সোমবার, ১ জুন, ২০২০

ডেস্ক রিপোর্ট::

করোনায় বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি। শুধু দেশ নয়, বিশ্ব অর্থনীতিও মহামারিতে বিপর্যস্ত। মার্চ থেকে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারি থেকেই অর্থনীতিতে ধাক্কা লাগে। দিন যত যাচ্ছে প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। একই সঙ্গে রাজস্ব আহরণ কমে যাচ্ছে। স্থবির হয়ে পড়েছে উন্নয়ন প্রকল্প। তবে অর্থবছরের প্রথম থেকেই রাজস্ব ঘাটতি পিছু ছাড়ছে না। অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দেশের ইতিহাসে মাইফলক স্পর্শ করবে। সবকিছুকে ছাপিয়ে আগামী অর্থবছর করোনার ক্ষত কাটিয়ে অর্থনীতিকে চাঙা আর বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে আগামী অর্থবছরের (২০২০-২১) বাজেট অনেকটা স্বস্তির হবে বলেই অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, করোনার আর্থিক ক্ষতি কাটাতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এবার আগামী বাজেটে করপোরেট কর কমানোর কথা ভাবা হচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাংক খাতে। বর্তমানে ব্যাংক খাতে করপোরেট কর সাড়ে ৩৭ শতাংশ। তা আড়াই শতাংশ কমতে পারে। ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগমুখী করতে এ ছাড় আসতে পারে। কারণ করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বড় বিনিয়োগ খুবই প্রয়োজন। বিনিয়োগ বাড়লে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। অপরদিকে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে করপোরেট কর কমাতে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) দাবি জানালেও গত কয়েক বছরে তার প্রতিফলন হয়নি। তাই এবার করোনার ক্ষতির সঙ্গে বিনিয়োগ চাঙা করতে করপোরেট কর কমানোর বিষয়ে চিন্তা করা হচ্ছে।

সূত্রমতে, আয়করের খাতের একটি বিশাল অংশ করপোরেট কর থেকে আয় হয়। সেজন্য ঢালাওভাবে সব খাতে করপোরেট কর কমানো হলে রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সেজন্য শুধু উৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে জড়িত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে করপোরেট কর কমানোর বিষয়ে কাজ হচ্ছে। পাঁচ বছর ধরে পুঁজিবাজারে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির ট্যাক্সহার ৩৫ শতাংশ বহাল আছে। এর পর তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও কয়েক দফায় ব্যাংকের করপোরেট ট্যাক্স কমানো হয়। কিন্তু ব্যবসায়ী সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির ট্যাক্স কমানো হয়নি। এবার উৎপাদনশীল খাতের কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্স আড়াই শতাংশ কমানো হতে পারে।

করপোরেট ট্যাক্স নিয়ে গত ছয় বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে করপোরেট ট্যাক্স আড়াই শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়, যা এখনও বহাল আছে। এর পরের অর্থবছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ট্যাক্স আড়াই শতাংশ কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের ট্যাক্স আড়াই শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪০ শতাংশ ও সিগারেট খাতে পাঁচ শতাংশ বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হয়। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও বহির্ভূত ব্যাংকের করপোরেট ট্যাক্স আরও আড়াই শতাংশ কমিয়ে যথাক্রমে সাড়ে ৩৭ শতাংশ ও ৪০ শতাংশ করা হয়।

বহুজাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান কেপিএমজির গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে করপোরেট কর সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে। ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা ৩৫ শতাংশ এবং ছোট কোম্পানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ। ভারতে করপোরেট করহার ৩০ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কায় ২৮ শতাংশ। আফগানিস্তানের করপোরেট করহার বাংলাদেশের চেয়ে কম; ২০ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভিয়েতনামের কোম্পানি পর্যায়ে করহার ২০ শতাংশ। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম কর্তৃপক্ষ করপোরেট করে ছাড় দেয়। এছাড়া মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়ায় ২৫ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ২৪ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুরে ১৭ শতাংশ করপোরেট কর বিদ্যমান আছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে করপোরেট করে ছাড় দেওয়ার বিকল্প নেই। বিশ্বের সব দেশ বিনিয়োগ বাড়াতে ছাড় দিয়েছে। বাংলাদেশে করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি চাঙা ও জিডিপি বাড়াতে হলে এ করে ছাড় দিতেই হবে। আগামী বাজেটে করপোরেট করের বিষয়ে বিবেচনা করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

অপরদিকে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হলেও তার সুফল আসছে না। কারণ বিনিয়োগ করতে গেলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ কালো টাকার মালিকরা বিড়ম্বনায় পড়েন। ফলে প্রতিবছর সুযোগ রাখা হলেও বিনিয়োগ হয় না। উপরন্তু এ টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। তবে আগামী বাজেটে করোনা মহামারির অভিঘাত মোকাবিলায় কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ প্রসারিত করার কথা ভাবছে সরকার। এ নিয়ে হিসাব কষা হচ্ছে। বিশেষ করে ঝিমিয়ে পড়া আবাসন খাত, উদীয়মান অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সম্ভাবনাময় হাইটেক পার্কের পাশাপাশি ট্রেজারি বন্ডে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হতে পারে।

এনবিআর সূত্রমতে, বাজেটে নতুন শিল্প স্থাপন, পুঁজিবাজার এবং আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের মাধ্যমে তা বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু খুব বেশি সাড়া নেই। সেজন্য আগামী বাজেটে দুই উপায়ে ঢালাওভাবে এ টাকা মূল অর্থনীতিতে বিনিয়োগের পথ খুলে দেওয়া হতে পারে। এর মধ্যে প্রথম হলো ঢালাওভাবে বিনা প্রশ্নে সাদা করার সুযোগ। সে ক্ষেত্রে ৫-১০ শতাংশ কর দিয়ে অবৈধ উপায়ে উপার্জিত টাকা ঘোষণায় আনলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না।

অপরদিকে বাজেটে কালোটাকা সাদা করার আরেকটি উপায় হলো বর্তমান সুবিধা সম্প্রসারণ করা। বর্তমানে এলাকাভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে কালোটাকায় ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ আছে। রাজধানী, চট্টগ্রাম, জেলা শহর ও পৌর এলাকাভেদে কালোটাকায় ফ্ল্যাট কিনে বর্গমিটারপ্রতি ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত কর দিলে কোনো প্রশ্ন করছে না এনবিআর। আগামী অর্থবছরে করের পরিমাণ কমিয়ে জমি কেনায়ও কালোটাকা ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হতে পারে। এছাড়া চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরেও অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকতে পারে। সেখানে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকৃত অর্থের ১০ শতাংশ কর দিলেই এখন প্রশ্ন করে না এনবিআর। ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত এই সুযোগ আছে। এ দুটি খাত ছাড়াও আরও কয়েকটি খাতে বিনা প্রশ্নে এ টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

এনবিআর সূত্রমতে, চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত কেউ হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে কালোটাকা বিনিয়োগ করেনি। গত এক বছরে কালোটাকায় ফ্ল্যাট কেনায়ও সাড়া নেই। দেশে এ পর্যন্ত ১৬ বার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ওই সময় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ সুযোগ নিয়েছিল। তখন ৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা বৈধ করা হয়।

অপরদিকে সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করতে চায়। কারণ প্রতিবছর তামাক খাত থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব আয় হয়, তার চেয়ে বেশি তামাকজনিত অসুস্থতার পেছনে ব্যয় হয়। সেজন্য এবার তামাকে বিশেষ করে সিগারেটের রাজস্ব বাড়বে। বিশেষ করে সিগারেটের সøাব কমিয়ে বাড়ানো হবে। এছাড়া ধূমপায়ীদের করোনা ঝুঁকি বেশি। ফলে ধূমপানে নিরুৎসাহিত করতে বিদ্যমান করের পাশাপাশি ‘কভিড-১৯ ট্যাক্স’ নামে একটি নতুন কর আরোপ করা হতে পারে। এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় এনবিআর থেকে মতামত চেয়েছে। সøাব কমিয়ে রাজস্ব বাড়ানো ও নতুন কভিড-১৯ ট্যাক্স আরোপ করা হলে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমার পাশাপাশি রাজস্ব বাড়বে।

এছাড়া বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা কমানো হতে পারে। কারণ কয়েক বছর ধরে এ সীমা তেমন কমানো হয়নি। মানুষের আয়ক্ষমতা বাড়ছে। ফলে করযোগ্য সবাইকে করের আওতায় আনতে এবার করমুক্ত আয়সীমা কমানো হবে। এতে করদাতার সংখ্যা বাড়বে এবং যারা সব সময় কর দেন, তাদের ওপর চাপ কমবে। বিলাসী পণ্যের মধ্যে প্রসাধনী, মোবাইল, গাড়িসহ বেশ কয়েকটি পণ্যে কর বাড়তে পারে।

সূত্রমতে, আগামী ১১ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের কথা রয়েছে। বাজেটের আকার হতে পারে প্রায় পাঁচ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের চেয়ে লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।


এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০