নোয়াখালী প্রতিনিধি:
শান্তির দূত মহাত্বা গান্ধীর স্মৃতি বিজড়িত নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার জয়াগ গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট এর সচিব, খ্যাতিমান গান্ধীয়ান ও শান্তি কর্মী শ্রীমতি ঝর্ণা ধারা চৌধুরীর আজ শনিবার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকি। গত বছর এই দিনে তিনি ৮০ বছর বয়সে তিনি রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাঁর প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে গান্ধি আশ্রম ট্রাষ্ট কর্তৃপক্ষ ঘরোয়া পরিবেশে এক স্মরন সভার আয়োজ করেছে। আজ শনিবার সকালে গান্ধি আশ্রম ট্রাষ্ট কার্যালয়ের মিলনায়তনে এ স্মরন সভা অনুষ্ঠিত হবে।
গান্ধি আশ্রম ট্রাষ্টের নির্বাহী পরিচালক রাহা নব কুমার জানান, সকাল দশটায় ঝর্ণা ধারা চৌধুরীর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পন ও প্রদীপ প্রজ্জলন, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ এর মধ্য দিয়ে আলোচনা সভা শুরু হবে। গান্ধি আশ্রম ট্রাস্টের সচিব তরুনী কুমার দাস এর সভাপতিত্বে ও অসীম কুমার বকশীর সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন সোনাইমুড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার টিনাপাল। বিশেষ অতিথি থাকবেন রাহা নব কুমার।
১৯৩৮ সালের ১৫ই অক্টোবর লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের কালিপুর গ্রামে এই ক্ষন জন্মা নারীর জন্ম হয়। তাঁর বাবা গান্ধীয়ান প্রমথ চৌধুরী ও মা আশা লতা চৌধুরী। ১১ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দশম। তিনি চট্টোগ্রামের খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন, কুমিল্লা ভিকটোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন চিরকুমারী । তার বাবার মৃত্যুর পর ১৯৫৬ সালে মহাত্মা গান্ধীর প্রতিষ্ঠিত অম্বিকা কালিগঙ্গা চেরিটেবল ট্রাষ্ট এ (গান্ধী আশ্রম ট্রাষ্ট) যোগদেন ঝর্ণা ধরা চৌধুরী। ১৯৬০ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সংসার ত্যাগীদের সংগঠন চট্টগ্রামের প্রবর্তক সংঘে যোগদানের মাধ্যমে সরাসরি মানব সেবায় নিয়োজিত হন তিনি। অনাথ শিশুদের জীবন গঠনে তিনি মূল্যবান ভূমিকা পালন করেছেন। অনাথ শিশুদের সেবা দিয়ে তিনি তাদের আতœপ্রত্যয়ী ও সাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন। তিনি তাদের শিখিয়েছেন জীবনে পরাজিত হতে নেই। জয় পতাকা হাতে অগ্রসর হয়ে জীবনকে স্বার্থক করে তুলতে হবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রামের প্রবর্তক সংঘের প্রায় ৫’শ শিশু ও কিশোরকে পাক হানাদার বাহীনির হাত থেকে বাচিয়ে তিনি আগরতলায় নিয়ে যান। সেখানে ত্রান কাজে তিনি সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহন করেন। হানাদার বাহিনীর হাতে নৃশংস ভাবে নিহত প্রবর্তক সংঘের কর্তা ব্যাক্তিদের মরদেহ সৎকার এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বিধ্বস্ত প্রবর্তক সংঘ পুনর্ঘঠনে তিনি নিরলস কাজ করেছেন।
ঝর্ণাধারা চৌধুরী ১৯৫৪ সালে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার জয়াগে প্রতিষ্ঠিত গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৯০ সালে তিনি গান্ধীআ¯্রম ট্রাস্ট এর সচিবে দায়িত্ব পান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই ট্রাস্টের সচিব ছিলেন। এই ট্রাস্ট নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ফেনী ও কুমিল¬া জেলার প্রায় বার লক্ষ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রচেষ্টার পাশাপাশি শান্তি, সম্প্রীতি ও অহিংসা প্রসারের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে এই ট্রাস্টের দ্বারা আটটি উপজেলার পৌনে দু’লক্ষ দরিদ্র পরিবার উপকৃত হচ্ছে। মানব সম্পদ উন্নয়নে ঝর্ণাধারা চৌধুরীর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরনীয়। গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের মাধ্যমে দরিদ্র জনগন শিক্ষার আলো লাভ করছে। তাছাড়া কৃষি, মৎসচাষ, কুটিরশিল্প প্রভৃতির মাধ্যমে গ্রামীন জনগনকে সাবলম্বী হতে তিনি সহযোগিত করেছেন।
ঝর্ণাধারা চৌধুরী আজীবন হতদরিদ্র, অসহায়, নির্যাতিত, বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্ঠায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ আলোর পথ যেমন খুঁজে পেয়েছে তেমনি বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পেয়েছে সমান তালে। গ্রামীন জনগণ দরিদ্রতা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাবার আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হয়েছে। ১৯৪৬ সালে নোয়াখালী দাঙ্গার সময় মাহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে উড়িষ্যা থেকে সত্যনারায়নজী দাঙ্গা পীড়িত অঞ্চলে কাজ করেন এবং আমৃত্যু তিনি এখানে অবস্থান করে সমাজসেবার গ্রামাঞ্চলে কাজ করেছেন। ঝর্ণাধারা চৌধুরী তাঁর জীবনী ‘সত্যনারায়ণজী’ প্রকাশ করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি স্বীকৃতি স্বরূপ আন্তর্জাতিক ‘বাজাজ’ পুরস্কার (বাংলাদেশে একমাত্র প্রাপক) লাভ করেন। এছাড়া তিনি নারী উদ্যোক্তার স্বীকৃতি হিসেবে ২০০২ সালে ‘অনন্যা’ পুরস্কার, সমাজসেবার জন্য ২০০৩ সালে নারীপক্ষ দুর্বার নেটওয়ার্ক, নিউইয়কেৃর ওল্ড ওয়েস্টবেরি ইউনিভার্সিটির শান্তি পুরস্কার, শান্তি, সম্প্রীতি ও অহিংসা প্রসারে ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শান্তি পুরস্কার’ লাভ করেছেন। নিঃস্বার্থভাবে সমাজসেবার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৭ সালে নোয়াখালী জেলা প্রশাসন থেকে ‘সাদা মনের মানুষ’ হিসেবে তিনি সম্মানিত হয়েছেন। সমাজসেবায় নিঃস্বার্থ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ শ্রীযুক্তা ঝর্ণাধারা চৌধুরীকে শ্রীচৈতন্য পদক ২০১০ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও তিনি চ্যানেল আই এবং রাধুনীর পক্ষ থেকে ”কীর্তিমতী নারী -২০১০” এবং ২০১১ সনে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের সবচেয়ে সম্মান সূচক পুরষ্কার ‘‘রনবীর সিং” পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১৩ সালে ভারত সরকার কতৃক পদ্মশ্রী পুরষ্কার একই বছর বেগম রোকেয়া পদক ২০১৫ সালে বাংলাদেশের জাতীয় পুরষ্কার ২১শে পদক ও ২০১৬ সারে ইংরেজী দৈনিক ডেইলী স্টার কর্তৃক সম্মাননা পদক লাভ করেন।
প্রকাশক ও সম্পাদক: মোহাম্মদ সেলিম , ঢাকা অফিস : সিটিহার্ট, সুইট নং ১৫/২, ৬৭ নয়াপল্টন, ঢাকা-১০০০। ই-মেইল:: nkbarta24@gmail.com
Copyright © 2024 Nk Barta 24. All rights reserved.