ডেস্ক রিপোর্ট:
১৯৭৪ সালে মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল সাদাত বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ৩০টি ট্যাঙ্ক উপহার দিয়েছিলেন। অথচ সেই ট্যাঙ্ক শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যের সঙ্গে হত্যার সময় ঘাতক সেনা কর্মকর্তারা শহরে ত্রাস সৃষ্টির জন্য সেসব ট্যাঙ্ক ব্যবহার করেছিল। যদিও সেসব ট্যাঙ্কে কোনো গোলাবারুদ ছিল না। সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
মিসর কেন ট্যাঙ্ক উপহার দিয়েছিল?
১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ আরবদের সমর্থন দিয়েছিল। আরবদের প্রতি সমর্থন এবং ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মিসরে চা পাঠিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল সাদাত বাংলাদেশের পাঠানো উপহারের কথা ভোলেননি। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মিসরের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আসেন।
তখন আনোয়ার আল সাদাতের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে জানানো হয়, মিসর বাংলাদেশকে ৩০টি ট্যাঙ্ক উপহার দিতে চায়। উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অস্ত্রভান্ডার গড়ে তোলা।
পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তাঁর লেখা ‘বাংলাদেশ : আ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ বইতে সে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।
সে বইটির বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ রক্তের ঋণ’ শিরোনামে। ১৯৮৮ সালে অনুবাদ করা সে বইটি প্রকাশ করেছে হাক্কানি পাবলিশার্স।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের লেখা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বর্ণনা অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমান ট্যাঙ্ক গ্রহণ করতে খুব একটা রাজি ছিলেন না। কিন্তু পররাষ্ট্র দপ্তর এবং মন্ত্রীরা তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হন যে মিসরের উপহার ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।
এই ট্যাঙ্কগুলো নিয়ে আসার জন্য তৎকালীন সেনাবাহিনীর একটি প্রতিনিধিদল মিসর সফরে যায়। ১৯৭৪ সালের জুন মাস নাগাদ এসব ট্যাঙ্ক বাংলাদেশে আসে।
তখন ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন মইনুল হোসেন চৌধুরী, যিনি মেজর জেনারেল হিসেবে অবসর নিয়েছেন এবং ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন। ২০১০ সালে জেনারেল চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর লেখা ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক’ বইতে মিসরের উপহার দেওয়া ট্যাঙ্ক সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে।
জেনারেল মইনুল লিখেছেন, তিনি শেখ মুজিবের কাছে মতামত দিয়েছিলেন যে, মিসর থেকে দেওয়া ট্যাঙ্কগুলো ঢাকায় রাখার প্রয়োজন নেই এবং প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুযোগ-সুবিধা নেই।
জেনারেল মইনুল লেখেন, ‘একদিন কথা প্রসঙ্গে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে ট্যাঙ্কগুলোকে উত্তরবঙ্গের রংপুর সেনানিবাসে পাঠানোর প্রস্তাব করি। ..কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আমার কথার কোনো গুরুত্ব দেননি। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ১৯৭৫ সালে মুজিব হত্যার সময় ওই ট্যাঙ্কগুলোই ব্যবহার করা হয়েছিল।’
মুজিব হত্যাকাণ্ড ও মিসরের দেওয়া ট্যাঙ্ক
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর ৪টার দিকে ঘাতক ফারুক রহমানের সহযোগী এবং অনুগত সৈন্যরা পরিকল্পনা অনুযায়ী সংগঠিত হতে লাগল।
ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে রাতের আঁধারে এত বড় ধরনের প্রস্তুতি গোয়েন্দারা টের পায়নি কেন, সেটি আজও এক বিরাট প্রশ্ন।
জড়ো হওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যেই ফারুক রহমান তার বাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করল।
সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বর্ণনা অনুযায়ী, গন্তব্যের পথে ফারুক ক্যান্টনমেন্টের গোলাবারুদের সাব-ডিপোর সামনে থামল।
সে ধারণা করেছিল, সেখানে ট্যাঙ্কের গোলাবারুদ এবং মেশিনগানের কিছু বুলেট পাওয়া যাবে। কামানের ব্যারেলের ধাক্কায় ডিপোর দরজা খোলা হলো।
কিন্তু সেখানে গোলাবারুদ বা মেশিনগানের বুলেট কিছুই পাওয়া যায়নি।
মাসকারেনহাস লিখেছেন, ‘সুতরাং ধোঁকা দিয়ে কার্যসিদ্ধি করা ছাড়া আর কোনো গতি রইল না।’
ফারুকের ট্যাঙ্কবহর যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন চতুর্থ এবং প্রথম বেঙ্গল পদাতিক বাহিনীর একদল সৈন্যের সঙ্গে তাদের দেখা হলো।
এ সময়ে তারা প্রাতঃকালীন পিটি করতে বের হয়েছিল। কিন্তু ফারুকের নেতৃত্বে ট্যাঙ্কবহর প্রশিক্ষণ এলাকা ছাড়িয়ে শহরের মূল সড়কের দিকে গেলেও কারো মনে কোনো প্রশ্ন জাগেনি।
ফারুক রহমানসহ ঘাতকদের মনে তৎকালীন রক্ষী বাহিনী নিয়ে উদ্বেগ ছিল। তারা ভেবেছিল, মুজিবকে হত্যা করতে গেলে রক্ষী বাহিনীর তরফ থেকে প্রতিরোধ আসতে পারে।
সে জন্য ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্কের বহর নিয়ে বের হয়ে ফারুক রহমান গিয়েছিল শেরেবাংলা নগরে রক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে। আরেকটি দল গিয়েছিল শেখ মুজিব, শেখ ফজলুল হক মনি ও আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে।
পাতা নং-২
তখন রক্ষী বাহিনীর উপপরিচালক ছিলেন আনোয়ার উল আলম। ২০১৩ সালে তাঁর লেখা ‘রক্ষী বাহিনীর সত্য-মিথ্যা’ বই প্রকাশিত হয়।
সে বইতে তিনি লিখেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের টেলিফোনে তাঁর ঘুম ভাঙে।
শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে বলেন, ‘শহীদ, মনির (শেখ মনির) বাসায় কালো পোশাক পরা কারা যেন অ্যাটাক করেছে। দেখো তো কী করা যায়?’
এরপর বিভিন্ন মারফত আনোয়ার উল আলম জানতে পারেন যে রাষ্ট্রপতির বাসায় হামলা হয়েছে। তাঁর বাড়ির পাশেও একটি গোলা এসে পড়ে।
আনোয়ার উল আলম লিখেছেন, ‘ঢাকা বিমানবন্দরের দেয়াল ভেঙে কয়েকটি ট্যাঙ্ক রক্ষী বাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়েছে। আমরা বুঝতে পারি, সেনাবাহিনীর একটি অংশ বিদ্রোহ করেছে এবং তারাই অভ্যুত্থান সংগঠিত করছে।’
আনোয়ার উল আলম আরো লেখেন, ‘আমরা সঙ্গে সঙ্গে রক্ষী বাহিনীর সবাইকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিই। সরোয়ার (তৎকালীন রক্ষী বাহিনীর উপপরিচালক) দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের তৈরি থাকতে বলেন।’
আনোয়ার উল আলমের বর্ণনা অনুযায়ী ঢাকায় প্রতিরোধ গড়ার মতো কোনো শক্তি রক্ষী বাহিনীর ছিল না। ট্যাঙ্ক নিয়ে ধোঁকা দিয়েছিল ফারুক রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে কর্নেল সাফায়াত জামিলের রুমে আসেন সাখাওয়াত হোসেন। তিনি পরবর্তী সময়ে ব্রিগেডিয়ার হিসেবে অবসর নেন এবং ২০০৭ সালে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন তাঁর ‘বাংলাদেশ : রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১’ বইতে।
ব্রিগেডিয়ার হোসেন লিখেছেন, সেখানে কিছুক্ষণ পরে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ এবং তার একটু পরে মেজর ফারুক রহমান (হত্যাকারী) আসে। ট্যাঙ্কের কালো পোশাক পরিহিত অবস্থায় মেজর ফারুক সে রুমে প্রবেশ করে। মেজর ফারুক তখন বলে, তার ট্যাঙ্কে কোনো গোলাবারুদ নেই। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত লিখেছেন, ‘এই প্রথম আমি জানলাম যে, ফারুকের কোনো ট্যাঙ্কেরই মেইন গানের কোনো গোলাবারুদ রাতের অভিযানের সময় এবং প্রায় সকাল ১০টা পর্যন্ত ছিল না। ….ফারুক আরো জানাল গোলাবারুদ না থাকা সত্ত্বেও তারা খালি ট্যাঙ্ক নিয়ে সবাইকে, এমনকি রক্ষী বাহিনীকেও ফাঁকি দিতে পেরেছে।’
ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত আরো লেখেন, ‘১৫ আগস্টে যখন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা করা হয়, তখন ফারুক দুটো ট্যাঙ্ক নিয়ে শেরেবাংলা নগরে রক্ষী বাহিনী হেডকোয়ার্টার ঘিরে ফেলে এবং সেখানে উপস্থিত ব্যাটালিয়নকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে।’শেখ মুজিবকে হত্যার জন্য ফারুক রহমান যেসব ট্যাঙ্ক নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছিল, সেগুলোতে কোনো গোলাবারুদ ছিল না। সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বইতেও এ তথ্য উঠে এসেছে। মাসকারেনহাস ঘাতক ফারুক রহমানের সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন। তার সঙ্গে কথোপকথনের ভিত্তিতে মাসকারেনহাস লিখেছেন, ‘ফারুক আমাকে পরে জানিয়েছিল, মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র হিসেবে ট্যাঙ্কগুলো যে কতটা কার্যকর, তা খুব কম লোকই জানে। ট্যাঙ্ক দেখে জীবনের ভয়ে পালানোর চেষ্টা করবে না, এমন সাহসী লোক খুব কম পাওয়া যাবে।
ফারুক যখন ট্যাঙ্ক নিয়ে রক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরের দিকে যাচ্ছিল, তখন তার মনেও সন্দেহ ও উদ্বেগ ছিল।
যেহেতু ট্যাঙ্কে কোনো গোলাবারুদ ছিল না, সে জন্য ফারুক রহমান তার সহযোগীদের বলেছিল চোখেমুখে সাহসী ভাব ফুটিয়ে রাখতে।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে ফারুক রহমান বলে, ‘আমরা যখন ওদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন রক্ষী বাহিনীর লোকেরা অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। আমরা তাদের দিকে তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে ছিলাম। সে ছিল এক ভয়ংকর অবস্থা। আমি ড্রাইভারকে বললাম, ওরা যদি কিছু করতে শুরু করে, দেরি না করে তাদের ওপরেই ট্যাঙ্ক চালিয়ে দেবে।’
ফারুক রহমান বলেন, ‘তার আর দরকার হয়নি।…নিজেদের সামনে হঠাৎ ট্যাঙ্ক দেখে, ওরা গায়ের মশা পর্যন্ত নাড়াবার সাহস পেল না।’
অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ফারুক রহমান স্বীকার করেন, ওই অবস্থায় কেউ যদি তাকে সত্যিকারভাবে প্রতিরোধ করতে চাইত, তাহলে তার কিছুই করার থাকত না।