ডেস্ক::
বৃদ্ধাশ্রম বলতে বৃদ্ধ নারী-পুরুষের আবাসস্থল বুঝায়। একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্য, চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সমগ্র বিশ্বে জীবনমানে এক বিরাট পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই বৃদ্ধদের সুরক্ষা দেওয়া বিশ্বব্যাপী তো বটেই, দেশেও একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতিসংঘ ৬০ বছর বয়সকে বার্ধক্য বা প্রবীণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ হিসাবে দেশে জনসংখ্যার ছয় দশমিক এক শতাংশ প্রবীণ
নর-নারী। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ১০ দশমিক এক শতাংশে। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবীণ পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেন এবং তাদের ভরণপোষণ, চিকিৎসা প্রভৃতির ভার সন্তানের ওপর বর্তায়। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নানা পরিবর্তনের কারণে যৌথ পরিবারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। একান্নবর্তী পরিবার বা যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। এতে প্রবীণরা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার অর্থাৎ আশ্রয় ও বাসস্থান হারাচ্ছে। জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ ভাগ প্রবীণেরই কোনো না কোনো সন্তান (দেশের ভেতরে অথবা বিদেশে) বাইরে থাকে। এদের সঙ্গে পিতা-মাতার যোগাযোগ হয় কম। এতে করে বৃদ্ধ পিতা-মাতা নানা সমস্যায় ভোগেন।
বর্তমান প্রেক্ষাপট লক্ষ করলে দেখা যায়, বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্য পরিবার ও স্বজনদের থেকে আলাদা আবাস বা আশ্রয়ের নাম বৃদ্ধাশ্রম। মূলত অসহায় ও গরিব বৃদ্ধদের প্রতি করুণা বোধ থেকেই বৃদ্ধাশ্রমের সৃষ্টি, যেখানে বৃদ্ধদের প্রয়োজনীয় সেবা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমের সেই ছবি এখন আর নেই। ছোটবেলায় যে মা-বাবা ছিলেন সন্তানের সবচেয়ে বেশি আপন, যাদের ছাড়া সন্তান কিছুই করতে পারত না, যারা নিজেদের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে সন্তানকে মানুষ করেছেন, সব দুঃখ-কষ্ট বুকে চেপে রেখে সন্তানের হাসিমাখা মুখ দেখার জন্য যে মা ব্যাকুল থাকতেন, সন্তান না খেলে যিনি খেতেন না, সন্তান না ঘুমালে যিনি ঘুমাতেন না, অসুস্থ হলে যিনি ঠায় বসে থাকতেন সন্তানের শিয়রে, সেই মা-বাবার শেষ বয়সের ঠিকানা এখনকার বৃদ্ধাশ্রমগুলো। এ যেন মানবতার প্রতি এক চরম উপহাস। দুই দশক আগেও আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম তেমন একটা ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
আজকাল বহু শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী ও চাকরিজীবী সন্তান মা-বাবাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ করেন না। মা-বাবাকে ঝামেলা মনে করেন। তাদের রেখে আসছে বৃদ্ধাশ্রমে। কখনও কখনও অবহেলা ও দুর্ব্যবহার করে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করে যেন তারা নিজেরাই ভিন্ন কোনো ঠাঁই খুঁজে নেন। অনেকের বিত্ত-বৈভবের অভাব না থাকলেও মা-বাবাকে কিছু অর্থ বা একটু সময় দেন না। তাদের সঙ্গে কথা বলার মতো পর্যাপ্ত সময় তাদের নেই। পত্রিকার পাতায় এর প্রমাণ মেলে। আগে বিভিন্ন সময় বৃদ্ধাশ্রম থেকে সন্তানের কাছে লেখা বৃদ্ধ পিতা-মাতার চিঠি পত্রিকায় ছাপা হতো। গণমাধ্যমের বরাতে দেখা গেছে, কিছু দিন আগেও রংপুরে এক বৃদ্ধা মাকে রাস্তায় ফেলে গিয়েছিল তার তিন ছেলে।
আমরা যারা বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে অবহেলা করছি, তাদের বোঝা মনে করছি, বৃদ্ধাশ্রমে তাদের ফেলে রাখছি, আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি আজ তারা বৃদ্ধ হতে পারেন, কিন্তু তারা তো বৃদ্ধ হয়ে পৃথিবীতে আসেননি। তারা তো পরিবারের বোঝা ছিলেন না, বরং সন্তানরাই তো তাদের কাছে বোঝা ছিল। তারা তো কখনও সন্তানদের বোঝা মনে করেননি। সন্তানদের বড় করে তোলার জন্য তারা বিন্দু পরিমাণ ত্রুটি রাখেননি। কত যত্ন করে বুকে আগলিয়ে সন্তান লালন-পালন করেছেন। মা প্রতিটি সন্তানের জন্য কতই না কষ্ট করেছেন। গর্ভধারণ থেকে শুরু করে প্রাপ্ত বয়স্ক পর্যন্ত মা সন্তানদের জন্য যে কষ্ট করেছেন, তার ঋণ কোনোদিনই শোধ হওয়ার নয়।
তাদের চাওয়া তো বেশি নয়। তারা শেষ বয়সটা নাতি-নাতনি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে আনন্দে কাটাতে চান। আমরা কেন বুঝতে পারি না, আজকের আমি কয়দিন পরেই বার্ধক্যে পা দেব। এটাই জীবনের স্বাভাবিক ধর্ম। আমরা কি ভেবে দেখেছি, আমি বৃদ্ধ হলে আমার আশ্রয় কোথায় হবে? তাই বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক আমাদের সবার ঠিকানা।
প্রবীণদের প্রতি বৈষম্য সমাজ-সংস্কৃতিতে একটি নিত্যকার নিদারুণ চ্যালেঞ্জ। কর্মক্ষেত্র, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, সামাজিক সেবা সুবিধা, গণমাধ্যম, বিনোদন, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, নীতিনির্ধারণ এবং পরিবার ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবীণরা নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আজকাল অনেক বৃদ্ধই আবাসিক ভবনে এসে আশ্রয় নেন। তাদের বেশিরভাগই বাধ্য হয়েই এই ভাগ্যকে বরণ করে নেন। আবার অনেকেই সুদীর্ঘ কর্মজীবন শেষে বৃদ্ধ বয়সে অবসরে নিজের মতো করেই স্বাধীনভাবে শেষ দিনগুলো কাটাতে চান, সন্তানের গলগ্রহ হয়ে থাকতে চান না।
দেশেই ইদানীং বয়স্কদের জন্য এমন বেশ কিছু বৃদ্ধ নিবাস গড়ে তোলা হচ্ছে। যদিও পশ্চিমা বিশ্বে যা স্বাভাবিক জীবনযাত্রার উপকরণ, আমাদের দেশে তার বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে এখনও ব্যক্তি থেকে পরিবারের গুরুত্ব বেশি। একান্নবর্তী ব্যবস্থা এখন খুব একটা না দেখা গেলেও পিতা-মাতাকে নিজের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হিসেবেই গণ্য করা হয়। ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বচ্ছন্দের চেয়ে পরস্পরের সান্নিধ্যের শান্তিটুকুর মূল্য আমাদের দেশে অনেক বেশি। তাই ছেলে বা মেয়ে স্বাবলম্ব^ী হলেই পিতা-মাতাকে ত্যাগ করে নিজে একা একা চলবে বা পিতা-মাতাকে আলাদা রেখে নিজে আলাদা থাকবে, এটা প্রত্যাশিত নয়। সন্তান সাবালক হলেই পিতা-মাতার দায়িত্ব যেমন শেষ হয় না, তেমনি পিতা-মাতা বৃদ্ধ হলে এবং কর্মহীন হলে, তার দেখাশোনা করার সামাজিক দায়ভার সন্তানকেই নিতে হয়। তাই পশ্চিমের ওল্ডহোম আমাদের জীবনধারায় প্রযোজ্য নয়।
বৃদ্ধাশ্রম আমাদের দেশে সংস্কৃতির অংশ না হলেও ইদানীং কিছুটা প্রয়োজন এবং অনেকটাই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ। অনেক মা-বাবা তার সন্তান বা সন্তানের স্ত্রীর কাছ থেকে অবহেলা, অযতœ, অবজ্ঞা, উপেক্ষা, মানসিক নির্যাতন, এমনকি কখনও কখনও দুর্ব্যবহারের শিকার হয়ে বাধ্য হয়েই আশ্রয় নেন বৃদ্ধনিবাসে অন্তত একটু সম্মান ও শান্তিময় জীবনের জন্য। অনেক নামিদামি বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, চাকরিজীবীও বৃদ্ধাশ্রমের স্থায়ী বাসিন্দা হতে বাধ্য হচ্ছেন।
তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, অনেকের জন্য বৃদ্ধনিবাস বিকল্প হতে পারে। অনেক বয়োবৃদ্ধ আছেন যার সন্তান নেই, এমনকি নেই কোনো নিকটাত্মীয়, যাদের কাছে তিনি শেষ দিনগুলো কাটাতে পারেন। কারও কারও সন্তান চাকরির কারণে অবস্থান করে দেশের বাইরে স্থায়ীভাবে এবং পিতা-মাতাকে তাদের কাছে নেওয়া সম্ভব হয় না আবার তারাও বিদেশে যেতে চান না। সন্তানরা টাকা-পয়সা পাঠাতে পারলেও পিতা-মাতাকে সময় দেওয়া তাদের পক্ষে আসলেই সম্ভব হয় না। তাদের জন্য বৃদ্ধনিবাস একটি ভালো ব্যবস্থা। থাকা-খাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে, শেষ জীবনের অবসর সময়টা কাটানোর সুযোগ করে দেয় এসব বৃদ্ধাশ্রম। এখানে যারা থাকেন, তারা সবাই মিলে একটা নতুন পরিবার গড়ে তোলেন।
বৃদ্ধাশ্রমে এসব প্রাপ্তির মাঝেও প্রবীণরা কি তার সন্তান আর নাতি-নাতনির কথা ভুলতে পারেন? বৃদ্ধ বয়সে সবাই তার সন্তান, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে একত্রে থাকতে চান, তাদের সঙ্গেই জীবনের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চান। সারাজীবনের কর্মব্যস্ত সময় পার করার পর অবসরে তাদের একমাত্র অবলম্বন এ আনন্দটুকুই। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় পাওয়া যায়, সঙ্গী-সাথী পাওয়া যায়, বিনোদন পাওয়া যায়, কিন্তু শেষ জীবনের এই পরম আরাধ্য আনন্দটুকু পাওয়া যায় না। তাই তারা এই সময়টাতে প্রবল মানসিক যন্ত্রণা আর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন, তাদের প্রিয় সন্তানের কথা ভেবে।
বর্তমান সরকার প্রবীণদের জন্য বয়স্ক ভাতা চালু করেছে। এ কার্যক্রমের আওতায় ১৭ লাখ দরিদ্র প্রবীণ সাহায্য পাচ্ছেন। এ ছাড়া সহায় সম্বলহীন প্রবীণদের জন্য সরকার ছয়টি বিভাগে ছয়টি বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছে। বেসরকারি পর্যায়েও মানসম্পন্ন বৃদ্ধাশ্রম ঢাকা এবং অন্যান্য শহরে রয়েছে।
প্রবীণদের সুরক্ষায় সরকার পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন ২০১৩ পাস করেছে। এ আইনে প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে হবে; কোনো পিতা-মাতার একাধিক সন্তান থাকলে সেক্ষেত্রে সন্তানরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে তাদের পিতা-মাতার
ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করবে। এ আইনের ৩ ধারায় পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে পিতা-মাতার একইসঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করবে; ৪ ধারায় কোনো সন্তান তার পিতা বা মাতাকে বা উভয়কে তার, বা ক্ষেত্রমতে, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করবে না; ধারা ৫ মোতাবেক প্রত্যেক সন্তান তার পিতা এবং মাতার স্বাস্থ্য
সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করবে; ধারা ৬ মোতাবেক পিতা বা মাতা কিংবা উভয়, সন্তান হতে পৃথকভাবে বসবাস করলে সেক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে নিয়মিতভাবে তার বা তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে।
করোনার সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগছেন সবাই। এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে মনের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়। আতঙ্ক, অহেতুক রাগ বা অবসাদের লক্ষণও দেখা দিতে পারে। এ সময় পরিবারে প্রবীণদের প্রতি বেশি যতœ নিতে হবে। বৃদ্ধাশ্রম কোনো মা-বাবার কাছেই কাম্য নয়। যারা সন্তানের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের সঙ্গে সন্তানের উচিত সহমর্মিতাপূর্ণ আচরণ করা। শেষ বয়সটা যেন তারা পরিবারের সঙ্গে আনন্দে কাটাতে পারেন, তা নিশ্চিত করা প্রত্যেক সন্তানের কর্তব্য। আমরা যেন ভুলে না যাই তাদের জন্যই আমরা পৃথিবীতে এসেছি। তাদের কাছে আমাদের ঋণ অপরিশোধযোগ্য।
প্রকাশক ও সম্পাদক: মোহাম্মদ সেলিম , ঢাকা অফিস : সিটিহার্ট, সুইট নং ১৫/২, ৬৭ নয়াপল্টন, ঢাকা-১০০০। ই-মেইল:: nkbarta24@gmail.com
Copyright © 2024 Nk Barta 24. All rights reserved.