ছবি: সংগৃহীত
গত ১১ বছর ধরে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার কাজ চলছে। তবে এমন কোনো কার্যকলাপ পরিলক্ষীত হচ্ছে না। উল্টো নতুন করে যে শিক্ষাক্রম তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে পঞ্চম শ্রেণেীকেই প্রাথমিকের স্তর নির্ধারণ করা হচ্ছে। এদিকে আবার শিক্ষানীতি-২০১০ও বহাল রাখা হয়েছে। যদিও এ দুটি সিদ্ধান্ত পরস্পর বিরোধী। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, তারা প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বহাল রাখার জন্য চেষ্টা করছে। স্থায়ীভাবে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে এ মন্ত্রণালয়। এসব ক্ষেত্রে সরকারের একটি সিদ্ধান্তের সঙ্গে আরেকটির কোনো মিল নেই। ফলে ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হোচট খেতে হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেছেন, প্রাথমিক শিক্ষাস্তর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হতে কোনো বাধা নেই। এটি ধাপে ধাপে সম্পন্ন হবে।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর উদ্যোগে একটা চমৎকার কারিকুলাম তৈরি হয়েছিল। যা প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ধারাবাহিক ও সমন্বিত শিক্ষাপ্রবাহ নিশ্চিত করতে পারে। এখন শুনছি, প্রাথমিকের আলাদা পাঠ্যক্রম তৈরি হচ্ছে। যার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আরও ভয়ের কথা, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড করা হচ্ছে। এসব পদক্ষেপ ক্ষতিকর। তা ছাড়া ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে বলা হচ্ছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। আমি মনে করি, প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা ধারাবাহিক শিক্ষার কারিকুলামই বরং চালু করা উচিত।’
এদিকে ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষাকাল পাঁচ বছর থেকে বর্ধিত করে ৮ বছর করা হবে। অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হবে প্রাথমিক স্তর। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে গেলে দুটি গূরত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। একটি হলো, অবকাঠামোগত আবশ্যকতা মেটানো এবং প্রয়োজনীয় উপযুক্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করা। আরেকটি হলো প্রাথমিক শিক্ষায় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নতুন পাঠ্যক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক-নির্দেশিকা প্রণয়ন করা। শিক্ষানীতিতে ২০১৮ সালের মধ্যে ছেলেমেয়ে, আর্থসামাজিক অবস্থা ও জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সব শিশুর জন্য পর্যায়ক্রমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছিল। অথচ সেই সময়সীমার পরও তিন বছর পেরিয়ে গেছে।
এমতাবস্থায়, দীর্ঘ এক দশক পাড় হয়ে গেলেও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নে কার্যকরের কোনো পরিকল্পনা বা রূপরেখা এখনও তৈরি করতে পারেনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাঠ্যক্রম প্রণয়নেও অগ্রগতি নেই। উল্টো পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর ধরে নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কাজ চলছে, যা ২০২৩ সাল থেকে চালু হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রাথমিক স্তরকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে ২০১৩ সালে একটি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে কোনো সভায় করেননি। এরপরে ২০১৬ সালে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের তৎকালীন সচিব মো. আলমগীরকে প্রধান করে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়। সেটিও কার্যকর কিছু করতে পারেনি। তবে পরীক্ষামূলকভাবে ৫০৩টি উপজেলা ও থানায় ৫০৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি চালু করার কথা থাকলেও পরে চালু হয়েছে ৬২৭টি বিদ্যালয়ে। পর্যায়ক্রমে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি খোলার মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা গত জেএসসি পরীক্ষায়ও অংশ নিয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, দেশজুড়ে প্রায় ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। ৬২৭টি বাদে বাকিগুলোতে নতুন করে তিনটি শ্রেণি খোলার লক্ষ্যে কোনো কাজ এখনও শুরু হয়নি। কারণ, এর সঙ্গে বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বিপুল পরিমাণ আর্থিক সংশ্লিষ্টতা বিদ্যমান।
এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা চৌধুরী বলেন, শিক্ষা-সংক্রান্ত ব্যাপারে সরকার থেকে একেক সময় একেক ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে লাখ লাখ শিক্ষার্থী, অভিভাবক দুশ্চিন্তা ও দুর্ভোগে পড়েন। এতে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই, স্নাতক ও বিএড ডিগ্রিধারী শিক্ষক নেই, কারিকুলাম প্রণয়ন হয়নি এবং নতুন কারিকুলামে পাঠ্যবইও শিক্ষার্থীরা পাবে না। এসব না করে তো প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা যাবে না।