হাকিমপুর (হিলি) দিনাজপুর:
ক্ষুধার্ত সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে নিজের মাথার চুল বিক্রি করে দিয়েছে একজন হতদরিদ্র মা। দিনাজপুরের হিলির পালিবটতলী গুচ্ছগ্রামে এই ঘটনা ঘটে। মাত্র সাড়ে ৩০০ টাকায় তিনি নিজের মাথার সব চুল বিক্রি করে দেন। আর সেই টাকা দিয়ে সন্তানদের খাবার কিনে দিয়েছেন তিনি। এমন নিদারুন কষ্টের খবর পেয়ে মধ্যরাতে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ওই মায়ের বাড়িতে গেছেন হাকিমপুর (হিলি) উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রাফিউল আলম। শুধু তা-ই নয়, তাদের স্বামী-স্ত্রীর জন্য একটি কাজেরও ব্যবস্থা করে দেন ইউএনও।
জানা গেছে, ২৫ বছর বয়সী সোনালী বেগম একজন নবমুসলিম, তার বিয়ে হয়েছে ৮ বছর আগে। তার এক ছেলে এক মেয়ে, স্বামী সোহাগ মিয়া এখন বেকার, আগে হোটেলে কাজ করতো। করোনার প্রাদুর্ভাবের ফলে হোটেলে চাকরি হারিয়ে সোহাগ সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়েন। অনেক চেষ্টা করেও কোনো কাজের সন্ধান মেলাতে পারেননি সে। অভাব অনটনের সংসারে তাই কিছুদিন ধরে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তাদের।
গেল দু’দিন সোনালী কোন ভাতের হাড়ি চুলাই চড়াতে পারেনি। নিজের ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে পারলেও ৭ ও ৪ বছরের দুই সন্তানের ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে এলাকায় চুল কিনতে আসা ব্যবসায়ীদের কাছে নিজের মাথা ন্যাড়া করে সমস্ত চুল মাত্র ৩০০ টাকায় বিক্রি করে দেন। চুল ব্যবসায়ী যখন বুঝতে পারলেন, অভাবের কারণে তিনি এই চুল বিক্রি করেছেন তখন তারা আরও ৫০ টাকা বেশি দেন এই মাকে।
খবর পেয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের পালিবটতলী গ্রামে খাদ্যসামগ্রীর বোঝা কাঁধে নিয়ে মাঝরাতে হতদরিদ্র পরিবারটির নিকট ছুটে যান ইউএনও রাফিউল আলম।
কথা হয় নবমুসলিম মা সোনালীর সাথে, তিনি বলেন, ৮ বছর আগে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে সোহাগকে বিয়ে করি। সংসারে আমার এক ছেলে এক মেয়ে। স্বামীর স্বল্প উপার্জনে সন্তানদের নিয়ে, আর দুঃখ-সুখ ভাগাভাগি করে কাটিয়ে দিচ্ছিলাম জীবন সংসার। করোনার কারণে স্বামী বেকার হয়ে পড়েছেন। কোন কাজ নেই তার। গত কয়েক দিন ধরে চুলায় ভাতের হাড়ি চড়েনি। সব সহ্য করা যায় কিন্তু সন্তানদের কষ্ট সহ্য করতে পারিনা। তাই কোন উপায় না পেয়ে চুলগুলো বিক্রি করে দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, সেদিন রাতে ইউএনও স্যার আমাদের বাড়িতে এসে ৮ দিনের খাবার দিয়ে গেছেন। আজকে আমাকে তিনি একটি সেলাই মেশিন এবং আমার সংসার আর সন্তানদের লালন-পালনের জন্য আমার স্বামীকে একটা ফুজকার দোকান করে দিয়েছেন। এমন দুর্দিনে স্যার যদি আমাদের পাশে না দাঁড়াতেন তাহলে বাচ্চাদের নিয়ে না খেয়ে থাকতে হতো।
ফুজকার দোকান পেয়ে সোহাগ আনন্দে উৎফুল্য হয়ে বলেন, আমি কোন দিন ভাবতে পারিনি যে, স্যার এভাবে আমাদের পাশে দাঁড়াবেন? কয়েক মাস থেকে আমি বড় বেকারত্ব জীবন-যাপন করছিলাম। আজ থেকে আমি এই ফুজকার ব্যবসা শুরু করলাম। আমি আর বেকার থাকবো না। হাটে-ঘাটে আর বাজারে ঘুরে ফুজকা বিক্রি করবো। আমার সংসারে আর কোন অভাব হবে না।
তিনি আরও বলেন, ফুজকার গাড়িসহ সকল সরঞ্জাম এবং ফুজকা বানানোর জিনিসপাতি কিনে দিয়েছেন তিনি। সাথে কিছু অর্থ হাতে দিয়েছেন। আমার স্ত্রীকে একটা সেলাই মেশিনও দিয়েছেন। সে সেলাইয়ের কাজ করতে পারে। আমরা দু’জন মিলে কাজ করবো এবং সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করব।
হাকিমপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রাফিউল আলম বলেন, গত কয়েকদিন আগে রাতে আমি জানতে পারি উপজেলার পালিবটতলী গচ্ছগ্রামে একটি অসহায় পরিবার সন্তানদের নিয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন এবং সন্তানদের মুখে খাবার দিতে মা তার মাথার চুল বিক্রি করেছেন। এমন সংবাদ পাওয়ার পর আমি নিজে ওই পরিবারের জন্য কয়েকদিনের খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, গত সোমবার (২ নভেম্বর) বিকেলে আমি ওই নবমুসলিম নারীকে একটি সেলাই মেশিন এবং তার স্বামীকে একটা ফুজকার গাড়িসহ সকল সরঞ্জাম কিনে দিয়েছি। এছাড়াও নবমুসলিম নারীকে উপজেলায় দর্জি কাজের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছে।