এনকে বার্তা ডেস্ক::
কভিড-১৯ ভাইরাসের ভয়াল থাবায় বিশ্ববাসী আজ বিপর্যস্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আজকের (২৭ মে, ২০২০) রিপোর্ট অনুযায়ী এ পর্যন্ত ২১৬টি দেশের প্রায় ৫৪ লাখ ৬০ হাজার মানুষ কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছে। আর মৃত্যু হয়েছে প্রায় তিন লাখ ৫০ হাজার মানুষের। বাংলাদেশেও আজ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৩৮ হাজার ২৯২, আর মৃত্যুর তালিকায় এসেছে ৫৪৪ জনের নাম। দিন দিন এ সংখ্যা বেড়েই চলছে। যেমনটা আশঙ্কা করা হয়েছিল, তার চেয়েও ভয়ংকর রূপে আক্রমণ চালাচ্ছে এ প্রাণঘাতী অণুজীব। বিপর্যস্ত করে তুলছে মানুষের জীবনাচরণ, স্থবির করে দিয়েছে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। অজানা আতঙ্কে অনেকটা নড়বড়ে হয়ে গেছে মানুষের ভাবনা আর স্বপ্নের জগৎ।
বৈশ্বিক পরিসংখ্যানের তুলনায় বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রথম দিকে কিছুটা কম থাকলেও গত কয়েক দিনের জ্যামিতিক বৃদ্ধি সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রঘোষিত সতর্কাবস্থা ও কয়েক দফা সাধারণ ছুটিসহ বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন অবস্থা থাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় অচল হয়ে আছে। এমন অবস্থার মধ্যে আর মাত্র কয়েকটা দিন পরই আমাদের দেশের ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, এফসিএ, এমপি। কেমন হতে পারে এবারের বাজেট, তা নিয়ে এখানে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
এরই মধ্যে করোনাভাইরাস মহামারিতে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দায় গতি আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় এক লাখ কোটি টাকারও বেশি আর্থিক ঋণ ও সহায়তার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনভাতা প্রদান, ক্ষতিগ্রস্ত বৃহৎ শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরে চলতি মূলধনের জন্য ঋণসুবিধা, আমদানি-রপ্তানি চলমান রাখতে প্রাক-জাহাজীকরণ ও ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি ঋণ, ছোট ও মাঝারি (এসএমই) খাতের জন্য বিশেষ বিনিয়োগ সুবিধা, এমনকি নিম্ন আয়ের পেশাজীবী ও কৃষকদের জন্যও বিশেষ ঋণের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এসব ঋণের অর্থ এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংকগুলো ছাড় করতে শুরু করে দিয়েছে। এছাড়া ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ সম্মানী, স্বাস্থ্য বিমা ও জীবন বিমা, বিনা মূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি, লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নগদ অর্থ বিতরণ, গৃহহীন মানুষের জন্য গৃহনির্মাণ, বোরো ধান ক্রয়, কৃষি যান্ত্রিকীকরণসহ কৃষকদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে এই প্রণোদনা প্যাকেজে।
সরকারের এসব সময়োপযোগী পদক্ষেপের জন্য এমন অর্থনৈতিক স্থবিরতার মধ্যেও মানুষের খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীর দ্রব্যসামগ্রীর কোনো অভাব দেখা যায়নি। নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষের পাশাপাশি ছোট-বড়-মাঝারি সব ধরনের শিল্প ও সেবা খাত এ প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা পাচ্ছে। তবে করোনা-পরবর্তী যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা করা হয়েছে, তা মোকাবিলায় আরও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী খাতওয়ারি আর্থিক ও পলিসিগত প্রণোদনা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা আশা করছি, প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক নিদের্শনা অনুযায়ী অর্থমন্ত্রী আসন্ন বাজেটে এ চাহিদা বিবেচনায় নেবেন।
আইএমএফের সাম্প্রতিক (এপ্রিল, ২০২০) রিপোর্ট অনুযায়ী, এ বছরের শুরুতে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশ আশা করা হলেও তা এখন ৩.০ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, যা ২০০৮-০৯-এর অর্থনৈতিক মন্দার চেয়েও ভয়াবহতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে ২০২১ সালের জন্য প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে ৫.৮ শতাংশ। আইএমএফের রিপোর্ট অনুযায়ী বছরের শুরুতে ৭.৪ শতাংশ আশা করা হলেও করোনাজনিত মন্দার জন্য ২০২০ সালে বাংলাদেশের জন্য প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে মাত্র ২.০ শতাংশ। তবে আশার কথা হলো আইএমএফের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১ সালের জন্য বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে ৯.৫ শতাংশ।
বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা সত্তে¡ও আমাদের এমন আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধির জন্য সুলভ শ্রমবাজার, ব্যাপক কৃষি উৎপাদন, ব্যক্তি খাতের উৎপাদনমুখী শিল্প ও বড় জনসংখ্যার নানা ধরনের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই বড় অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জন অনেকটা নির্ভর করবে এবারের বাজেটে আয়ের সুসম বণ্টন ও বাজেট বাস্তবায়নের নীতিগত কর্মকৌশলের ওপর। তাই এবারের বাজেটের গুরুত্ব ও প্রত্যাশা দুইই অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক বেশি।
গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রায় পাঁচ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল, যা ছিল পূর্ববর্তী সব বাজেটের চেয়ে বড়। এবারের বাজেটের আকারের চেয়েও খাতওয়ারি বরাদ্দের সঙ্গে বাস্তবায়নের নীতি ও পলিসি অধিক গুরত্ব পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বরাদ্দের দিক থেকে গত বছরে সর্বোচ্চ ছিল পরিবহন ও যোগাযোগ খাত, যা প্রায় ২৬.১ শতাংশ। এছাড়া শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে ১৮.১ শতাংশ, স্থানীয় সরকার ও গ্রামোন্নয়নে ১৫.৪ শতাংশ, জ্বালানি খাতে ১৩.২ শতাংশ, জনপ্রশাসনে ৬.১ শতাংশ, স্বাস্থ্যসেবায় ৫.৮ শতাংশ, কৃষিতে ৫.৪ শতাংশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা ও অন্যান্য খাতে ছিল যথাক্রমে ২.৭ শতাংশ ও ৭.২ শতাংশ। আসন্ন বাজেটে স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতের পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা ও জনকল্যাণ খাতে পূর্বাপেক্ষা বেশি বরাদ্দ পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
স্থবির অর্থনীতিতে প্রাণ আনতে কর কাঠামো ও কর ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনাও জরুরি হয়ে পড়তে পারে। পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিং খাতের দিকেও নজর দিতে হবে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে। যদিও অন্যান্য বছরের মতো বাজেট প্রস্তুতির অংশ হিসেবে যেমন করে বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠন, গবেষক, পেশাজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সবার মতামত ও পরার্মশ গ্রহণ করা হয়, এবার প্রতিক‚ল বাস্তবতায় তা হয়ে ওঠেনি। তবুও অর্থমন্ত্রী তার নিজস্ব জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার আলোকে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য সুফল আনবে এমন একটি বাজেট উপস্থাপন করবেন বলে আমরা আশা করছি।
গত বাজেটের আয় খাতে সর্বোচ্চ অবদান রেখেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন কর রাজস্ব, যা ছিল মোট আয়ের ৬২.২ শতাংশ। এর পরই ছিল ১৪.৮ শতাংশ অভ্যন্তরীণ ঋণ ও ১২.২ শতাংশ বৈদেশিক ঋণ। বাকিটার জোগান আশা করা হয়েছিল এনবিআর-বহির্ভ‚ত কর ও অন্যান্য রাজস্ব আয়ের ওপর। কর রাজস্ব আদায় ও বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে এবারের বাজেটে প্রত্যাশা কিছুটা সীমিত থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। তদুপরি করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা, ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা ও দীর্ঘসময় জনগণের জন্য নিরবছিন্ন চিকিৎসাসেবা ও খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা এ বাজেটের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে হচ্ছে। আর এসব চালেঞ্জের বিপরীতে বাজেট হতে হবে যথেষ্ট মাত্রায় বাস্তবমুখী, নির্দেশনামূলক ও জনবান্ধব। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনার আলোকে আমাদের অর্থমন্ত্রী একটি সময়োপযোগী ও বস্তুনিষ্ঠ বাজেট সংসদে উপস্থাপন করে দেশের মানুষকে এ ভয়াবহ মহামারিসৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্ভোগ থেকে রক্ষার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করবেন-এমন আশা রাখছি আমরা সবাই।
মোস্তফা সাজ্জাদ হাসান, এফসিএ, সিপিএ
চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট ও ব্যবসায় পরামর্শক, lead@mshanca.com