১৯৯৬ সালে জেলার দক্ষিণ অঞ্চলের কৃষি পন্যের বাজার সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার কালামুন্সি বাজারে সরকারি ভাবে তৈরি করা হয় ‘কৃষি মার্কেট’। দেশের ২৯টি কৃষি মার্কেটের মধ্যে এটি একটি। ১ একর ৯৬শতক জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত এ মার্কেটটি ২০০০ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধন করা হয়। সম্প্রতি জেলা কৃষি বিপনন কর্মকর্তার যোগসাজশে মার্কেটটির সড়ক, গলি, গোসালা, টয়লেট সহ বিভিন্ন স্থানে অবৈধ বরাদ্দ দিয়ে গড়ে উঠেছে অন্তত ১৩টি স্থাপনা। কৃষি বিপনন কর্মকর্তার এমন কর্মকা-ে নিয়মিত অবাক উপজেলা প্রশাসন ও মার্কেট পরিচালনা কমিটির অন্য সদস্যরাও।
জানা যায়, কৃষি বিপনন অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে মার্কেটটিতে ১টি অফিস (কৃষি বিপনন) কক্ষ, ২৪টি দোকান ও ৪টি ওপেন সেড নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের পর থেকে বিভিন্ন সময় ২৪ দোকান দরপত্রের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া হলেও গ্রাহক শূন্য থাকে ৪টি ওপেন সেড। ২০১৭/১৮ অর্থবছরে প্রতি বছর ১০% ভাড়া বৃদ্ধি হারে দরপত্রের মাধ্যমে সেডগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়।
স্থানীয়রা বলছেন, মার্কেটটির বয়স দীর্ঘদিন হলেও পরিবেশের কারনে সেটি কখনও জমে উঠেনে। মাদক সেবীদের আড্ডা ও গুরু-ছাগলের চারনভূমি ছিলো এটি। গত ৩-৪ বছর থেকে মার্কেটটি নিজের স্বরূপে ফিরে আসে। এরই মধ্যে বরাদ্দকৃত ঘরগুলোর বাহিরে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী, অসাধু লোকজনের সাথে যোগসাজশ করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অবৈধ স্থাপনা তৈরির অনুমতি দেয় জেলা কৃষি বিপনন কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাস ও একই প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার অপারেটর মুদ্রাক্ষরিক মোশারেফ হোসেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, উদ্বোধনের দীর্ঘ সময় ধরে মার্কেটটি এভাবে পড়ে ছিলো। গত কয়েক বছরে এটি কিছুটা জমতে শুরু করে। আর তাতেই মার্কেটের দিকে নজর পড়ে স্থানীয় কয়েকজন অসাধু ব্যক্তির। তারপ্রেক্ষিতে কৃষি বিপনন কর্মকর্তা ও কম্পিউটার অপারেটরের সাথে যোগাযোগ করে মোটা অংকের টাকা লেনদেন করে মার্কেটের বিভিন্ন খালি জায়গা ভুয়া কাগজের মাধ্যমে বরাদ্দ দেখিয়ে দখল করে স্থাপনা নির্মাণ শুরু করে। এটা নিয়ে বাধা দিতে গিয়ে একাধিক বার স্থানীয় ও দখলদারদের সাথে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনার জেরে বিপনন কর্মকর্তার নির্দেশে কম্পিউটার অপারেটর মোশারফ দাঁড়িয়ে থেকে অবৈধ ঘরগুলো নির্মাণে সহযোগিতা করেন।
অবৈধ বরাদ্দ পাওয়া আবুল কাশেম নামের একজন বলেন, কৃষি বিপনন অফিসের মোশারফের কাছ একটি কাগজ ও আট হাজার টাকা দিয়ে আমি একটি জায়গা বরাদ্দ নিয়েছি। সেখানে একটা দোকান তৈরি করা হয়েছে। কাগজে চুক্তি হয়েছে এক বছরের জন্য।
আবু নাছের নামের আরও একজন বলেন, এটা বৈধ কিনা অবৈধ তা আমার জানা নেই। আর আমি অবৈধ ভাবে কেন এখানে ঘর করবো। আমি ১২হাজার টাকা দিয়ে কৃষি বিপনন অফিস থেকে কাগজ নিয়েছি।
একাধিক সূত্র বলছে, অবৈধভাবে গড়ে উঠা প্রতিটি ঘরের মালিক থেকে কৃষি বিপনন কর্মকর্তা নিজে স্বাক্ষর করে জায়গাগুলো তাদের বরাদ্দ দিয়েছেন। অবৈধ বরাদ্দ পত্রে মহা-পরিচালক ও উপ-পরিচালককে অনুলিপি দেওয়ার তথ্যটিও ভূয়া ছিলো।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি বিপনন অধিদপ্তর নোয়াখালীর অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার অপারেটর মুদ্রাক্ষরিক মোশারেফ হোসেন বলেন, মার্কেটে নির্দিষ্ট দোকান ও সেডের বাহিরে কিছু জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে আমি কারো কাছ থেকে কোনো টাকা নি-নাই। আমার স্যার (বিপনন কর্মকর্তা) যেভাবে বলেছেন আমি শুধু ওইভাবে কাজ করেছি।
মার্কেট পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও কবিরহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতিমা সুলতানা বলেন, কৃষি বিপনন কর্মকর্তা মার্কেট পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব। উনার বাইরে আমি ছাড়াও আরও ৮জন সদস্য রয়েছে। চালুর পর থেকে মার্কেটটি ঠিকঠাক ভাবেই চলছিলো। কিন্তু গত বছর এ বিপনন কর্মকর্তা যোগদানের পর নিজের একক সীদ্ধান্তে ও ব্যক্তিস্বার্থে সড়ক, গলি, গোসালা, টয়লেট সহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১৩টি স্থাপনা বরাদ্দ দিয়েছেন। বরাদ্দ পত্রে ভূয়া অনুলিপি দেখিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মহা-পরিচালক ও উপ-পরিচালককে। ইত্যেমধ্যে আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি, পরিদর্শনকালে অবৈধ স্থাপনা বরাদ্দ ও নির্মাণের সত্যতা পাওয়া গেছে। মার্কেটের গুদামটিও এক বছরের জন্য বরাদ্দ দিয়েছেন বলেও আমরা প্রমাণ পেয়েছি।
নির্বাহী কর্মকর্তা আরও বলেন, বিষয়টি আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বিপননের মহা-পরিচালককে অবগত করেছি। অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদের জন্য অনুমতি চেয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর আবেদন করা হয়েছে। নির্দেশনা ফেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে সেগুলো উচ্ছেদ করা হবে।
ভূয়া অনুলিপি দেখিয়ে অবৈধ স্থাপনাগুলো নিজে বরাদ্দ দিয়েছেন বলে স্বীকার করে জেলা কৃষি বিপনন কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাস বলেন, ওই লোকগুলো গত ৭-৮বছর ধরে মার্কেটের খালি জায়গাগুলো দখল করে রেখেছিলো। পরে আমি বিষয়টি জানার পর তারা আমার কাছে এক বছরের সময় চেয়েছিলো, তাই আমি তাদের এক বছরের জন্য কাগজ করে দিয়েছি।
বরাদ্দ দেওয়া অবৈধ ছিলো কী-না এবং ওই পত্রে অনুলিপি যাদের দেখানো হয়েছে তথ্যটি সত্য ছিলো কী-না এমন প্রশ্নের জবাবে এ কর্মকর্তা বলেন, মানবিক দিক বিবেচনা করে আসলে তাদের বরাদ্দ দিয়েছিলাম, পত্রে লেখা থাকলেও আসলে অনুলিপি কাউকে দেওয়া হয়নি। আমরা অবৈধ স্থাপনাগুলোর মালিককে দ্রুত সময়ের মধ্যে নোটিশ করবো, নোটিশের পর যদি সেগুলো সরানো না হয় তাহলে তাদের উচ্ছেদ করা হবে।