ডেস্ক রিপোর্ট::
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে নারী ঘরে বসে নেই। ঘরে-বাইরে সব ক্ষেত্রে সমানভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। রক্ষণশীল সমাজে অনেক বাধা পেরিয়ে নারী এগিয়ে চলেছে স্বমহিমায়। নারীশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রেও বিশ্বে বাংলাদেশ এখন অনুকরণীয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শীর্ষ পর্যায়ে সবাই নারী। গত কয়েক বছরে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ে প্রথমবারের মতো একজন নারী কমিশনার দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে মাইলফলক। বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে সর্বপ্রথম নারী স্পিকার নিয়োগ পেয়েছেন। জাতীয় সংসদেও সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন বেশ কয়েকজন নারী সংসদ সদস্য। সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০টিতে উন্নীত করা হয়েছে। উপজেলায় নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদ সংরক্ষিত রয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সরাসরি ভোটে চেয়ারম্যান ও মেম্বার নির্বাচিত হচ্ছেন নারী। তৃণমূল পর্যায়ে নারীর যে ব্যাপক রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়েছে, তাও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরেই। সম্প্রতি প্রকাশিত গ্লোবাল জেন্ডার রিপোর্ট অনুযায়ী, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে সপ্তম।
নারী পুলিশ অফিসার ও সার্জেন্টসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে আজ নারী ট্রাফিক পুলিশ পুরুষের পাশাপাশি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কাজ করে যাচ্ছেন। সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীতে নারী অফিসার নিয়োগ নারী উন্নয়ন ও নারী জাগরণের এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। নারী পাইলটরা বিমানবাহিনীর জঙ্গি বিমানও ওড়াচ্ছেন। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিতেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নারী ব্যাটালিয়ন।
স্বাধীন বাংলাদেশেও নারীরা সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার ছিল। নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল নেতিবাচক। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় নারী পরাধীনতার সে শেকল ভাঙতে শুরু করেছে। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া নারীশিক্ষার যে বীজ বপন করেছিলেন, বর্তমানে সে পথ ধরেই নারী এগিয়ে চলেছে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েশিশু ভর্তির হার দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে বর্তমানে ভর্তির হার প্রায় ৯৮ শতাংশ। এর মধ্যে মেয়েশিশু ভর্তির হার ছেলেশিশুর তুলনায় বেশি। বিগত কয়েক বছরের এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলেও সব কয়টি শিক্ষা বোর্ডে মেয়ে শিক্ষার্থীরা ছেলেদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। ফলাফলেও মেয়েরা এগিয়ে। এমনকি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডেও ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে আছে। সরকারিভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বিনা মূল্যে পাঠ্যবই পাচ্ছে। দরিদ্র পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা উপবৃত্তি পাচ্ছে। মেয়েরা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়তে পারছে। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ‘মিড ডে মিল’ কর্মসূচি। এখন আর খুদে শিক্ষার্থীদের স্কুলে এসে অভুক্ত থাকতে হবে না। ডিগ্রিতে পড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। উ””শিক্ষার ক্ষেত্রেও মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। বর্তমানে দেশের মোট ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীর ৩০ শতাংশ নারী। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (বুয়েট) পরিসংখ্যান দেখা যায়, ¯œাতক পর্যায়েও নারী শিক্ষার্থীর হার দ্রুত বাড়ছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারি চাকরিতে নারীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে বর্তমানে ২৭ শতাংশ নারী, যা ২০১২ সালে ছিল ২১ শতাংশ। ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফ, ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট চাকরিজীবীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৫৫। এর মধ্যে নারী চাকরিজীবীর সংখ্যা তিন লাখ ৭৫ হাজার ৭৮৭, যা মোট চাকরিজীবীর ২৭ শতাংশ। অর্থাৎ আট বছরে সরকারি চাকরিতে নারী কর্মজীবীর সংখ্যা বেড়েছে ছয় শতাংশ। এ বৃদ্ধি হয়েছে মূলত নারীর শিক্ষার হার বাড়ার পাশাপাশি সরকারের নারীর ক্ষমতায়ন বাস্তবায়ন অঙ্গীকার পূরণের মাধ্যমে। পোশাকশিল্প, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানেও নারীর অধিক হারে নতুন নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী দেশের প্রধান খাত পোশাকশিল্পে প্রায় ৪০ লাখ নারী কর্মরত। এছাড়া চা ও চামড়াশিল্পেও ব্যাপকভাবে কাজ করছে নারী। কৃষি খাতে প্রায় ৬৫ শতাংশ নারী কর্মরত। এ সংখ্যা আরও বাড়ছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, তারা পুরুষের সমান কাজ করেও মজুরি কম পায়। তারা মজুরিবৈষম্যের শিকার। এ বাস্তবতায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গ্রামীণ সুবিধাবঞ্চিত এক কোটি নারীর ক্ষমতায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তাদের বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত নারীকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করা হচ্ছে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) খাতে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে নারী। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে এখন নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। পাঁচ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদেও রয়েছে নারী। মোট শ্রমশক্তিতে তাদের অংশগ্রহণ ৩৩ দশমিক পাঁচ শতাংশ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদেও তারা সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। যে কোনো চ্যালেঞ্জিং পেশায় এখন তারা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। বিগত কয়েক বছরে বিদেশে নারীকর্মী গমনের হার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। গত বছর প্রায় এক লাখ ৬৮ হাজার নারীকর্মী বিদেশে গেছে, কিন্তু বিশ্বব্যাপী মারণব্যাধি কভিডের কারণে বিদেশে নারীকর্মী প্রেরণ থমকে গেছে। এই বৈশ্বিক মহামারির উত্তরণ ঘটলে আবার আগের মতো বিদেশে তারা যেতে পারবে।
সরকার নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে খুব আন্তরিক বলেই নারীর পথচলার প্রতিবন্ধকতা ক্রমেই দূর হচ্ছে। উচ্চ মজুরির কাজে নারীরা সুযোগ পাচ্ছে। কর্মজীবী মায়েরা যাতে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারে, সেজন্য কর্মক্ষেত্রে ডে-কেয়ার সেন্টার তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া পুরুষের মানসিকতারও পরিবর্তন হচ্ছে। তারা নারীকে চাকরিতে বা আয়বর্ধক কাজে উৎসাহ দিচ্ছে। এসব কারণেই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় নারীর অংশগ্রহণ ক্রমাগতভাবে বাড়ছে।